শনিবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৫

বেনসন সাহেবের বৈজ্ঞানিক কারখানা―রায়ান নূর

আরে একি! স্বপ্নকেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়! অবিশ্বাস্য ! কোন কালে শুনিনি জলে ইঞ্জিন চলে এমনকি একটি আস্ত স্বয়ংক্রিয় কার! ভিজিটিং কার্ডে ভিডিও-কল ! অদৃশ্য দেয়াল;তাও আবার একটা কারখানা পুরো অদৃশ্য করে রাখে ! দেখছি সবকিছুই কেমন স্বয়ংক্রিয় কাজ করে যাচ্ছে  ৷ অবিশ্বাস্য! 
ওগুলো কি ইঁদুর ? ওরাও মানুষের মতো ইলেক্ট্রনিক্সের কাজ করে?   বেনসন কিভাবে এসব করলি?
― দেখতে হবে ব্যক্তিটা কে? বেনসন ৷ মাষ্টারমশায় যেখানে গুরু বেনসন সেখানে কখনো বিফল হয়?
― ও,হ্যাঁ মাষ্টারমশায়ের দাতব্য বিশ্ববিদ্যালয় কি কোন অধ্যাপক ছাড়াই চলে ৷ নাকি পুরো ডিজিটাল?
― মাষ্টারমশায়ের ফেরারী দাতব্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ডিজিটাল অধ্যাপক,ডিজিটাল কর্মচারী ৷ আর কোন মানুষের বালাই নেই ৷
―অবাক হলেম, তুই সবকিছুই পারবি! একটা কারখানাও করেছিস যেখানে রোবটের ছড়াছড়ি ৷ মানুষ পর্যন্ত যাবার অনুমতি নেই ৷ কি মিথ্যে বললাম!
―তুই যখন সবই জানিস,খামোখা অবাক হবার দরকার কী? বৈজ্ঞানিক কারখানা যখন হয়েছে ৷ এরপর দেখবি নিত্য নতুন কত ডিজিটাল বুদ্ধি ৷ আবিষ্কারের সংখ্যা মহাগ্রন্থ  লিখলেও শেষ হবেনা রে ৷ মাষ্টারমশায় বলে,‘যাদের মাথায় পার্থিব বিষয় সহজে ধোপে টিকে না,তারাই কেবল দুই-এক লাইন লিখে ৷’
―তা বটেই,তোর পরবর্তী পরিকল্পনা কী শুনি? না এক কারখানাতে সবকিছু চুকিয়ে দিবি?
― মাষ্টারমশায় মাষ্টার-প্ল্যান দিয়েছে বানাতে হবে সাত-তারা হোটেল যেখানে সবকিছু স্বয়ংক্রিয়, থাকবে ননস্টপ জেনারেটরের ব্যবস্থা ৷
―বুঝলুম তুই মস্ত বড় বিজ্ঞানী, দেখিস সব প্রযুক্তি যেন কাগুজে লেখক চুরি না করে ৷
― বিন্দু নিয়ে সিন্ধু গড়া যায় না ৷ পৃথিবীর উন্নতমানের এই কারখানায় তাইতো মানুষ প্রবেশে কড়া নিষেধারোপ ৷ সবই মাষ্টারমশায়ের মাষ্টার-প্ল্যান ! আমি তো নদীমাত্র ৷   

বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

রুবাইয়াত ই ওমর খৈয়াম

*রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়ামঃ কান্তিচন্দ্র ঘোষ ও নজরুল                                     
                                     রায়ান নূর

ওমর খৈয়াম বর্তমানে জগদ্বিখ্যাত কিংবদন্তী ৷ তিনি তার বিজ্ঞানের খোলস ছেড়ে কবে দার্শনিকতার স্তরে উপনীত হয়েছেন আর সীমাহীন প্রশ্ন জিজ্ঞাসায় রচনা করেছেন অমৃতসূধাস্বরূপ রুবাইয়াৎ যার অস্তিত্বে এখনো পন্ডিতগণ একমত হননি ৷ তার দর্শন উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে কালান্তরে;তার লক্ষণ মেলে আল্লামা ইকবালের পঙ্কতি ও তার‘আসরারে খুদী’তে ৷ যেমনঃ

এক তু হ্যায় কে হক হ্যায় ইস জাহাঁ মেঁ
                           বাকী হ্যায় নমুদ সিমিয়াই ৷
(এ দুনিয়ায়, হে মানুষ তুমিই একমাত্র সত্য,বাকী সবই মরীচিকা ৷)

তিনি যে রুবাইয়াৎ(চতুষ্পদী কবিতা) লিখেছিলেন তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলে যখন এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড 110 টি রুবাইয়াতের ইংরেজী অনুবাদ করে গোটা ইউরোপকে তাক লাগিয়ে দেন ৷ যদিও রুবাইয়াতের সংখ্যা আরো অধিক পরিমাণে ছিল ৷ এরপর বহুভাষায় এমনকি বাংলাভাষায় এই রুবাইয়াতগুলোর অনুবাদ হয়েছে ৷ অনেক রুবাইয়াৎ পাওয়া গেছে খৈয়ামের নামে তা থেকে 66 টি রুবাইয়াত  প্রশ্নাতীতভাবে খৈয়ামেরই হতে পারে তা পন্ডিতগণ স্বীকার করেছেন ৷ বলাবাহুল্য ফিটজেরাল্ড সম্পূর্ণ নির্মোহ থেকে তার অনুবাদ সম্পন্ন করতে পারেন নি,এতে তাঁর অদম্য কবিত্বপ্রতিভার আঁচ লেগেছে যার ফলস্বরূপ অনেক ক্ষেত্রে অনুবাদগুলো মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ভাব,ভাষাভঙ্গী কিংবা ছন্দের দিক থেকে ৷ তবু তার দর্শনের ছোয়া রুবাইয়াতগুলোকে নিরাসক্তভাবে ঐক্য সাধন করেছে ৷

বাংলাভাষায় ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ,কাজী নজরুল ইসলাম,কান্তিচন্দ্র ঘোষ,নরেন্দ্র দেব সহ অনেকেই অনুবাদ করেছেন ৷ তার মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম,নরেন্দ্র দেব ও কান্তিচন্দ্র ঘোষের অনুবাদ বিশেষ প্রণিধানযোগ্য ৷ কান্তিচন্দ্র তার অনুবাদকে সাবলীল ও হৃদয়গ্রাহী করার প্রয়াসে খৈয়ামের ফার্সী ছন্দ ব্যতিরেকেই  ফিটজেরাল্ডকেই অনুসরণ করেছেন যা মাত্রারিক্তভাবে নরেন্দ্র দেব, সিকান্দার আবু জাফরের অনুবাদেও লক্ষ করা যায় ৷ খৈয়ামের রুবাইয়াতের ভাষা,প্রকাশভঙ্গি ছিল অত্যন্ত সরল ও নৈসর্গিক ৷ অদৃষ্টের প্রতি নিরাসক্তি,স্বর্গের প্রতি অনাস্থা,ভবিষতের প্রতি অনীহা,অতীতের মোহ-ত্যাগ,প্রভুর নির্বিকার অবিচার, মৃত্যুর প্রতি চিরবিশ্বাস আর সামগ্রিকভাবে বর্তমানকে উদযাপনই ছিল তার রুবাইয়াতের প্রাণশক্তি ৷ তাই তার অনুবাদগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তিবিশেষে স্থান করে নিয়ে বিশেষ থেকে সামান্যে প্রত্যাবর্তন করেছে বিভিন্ন রূপ আর আঙ্গিকে ৷ কোন কবিই পারে নি তাকে নিয়মের ছকে বাধতে বরং অন্তর্নিঃসৃত বাণী ভাস্বর হয়েছে সকল অনুবাদে ৷  

খৈয়ামের অনুবাদ হয়েছে তিন শ্রেনীতে প্রথমত ভাবমুখ্য, দ্বিতীয়ত গতিমূখ্য,তৃতীয়ত ভাব-গতি মূখ্য ৷ কাজী নজরুল ইসলাম ও কান্তি ঘোষের অনুবাদে তৃতীয় লক্ষণটি স্বরূপে বিরাজমান ৷ কাজী নজরুল ব্যতিত এই অনুবাদকগণ ফার্সী ভাষা জানতেন কিনা তা সহজে বোধগম্য নয় ৷ যদিও জেনে থাকতে পারেন তবে বলতে হয় ইংরেজ কবি ফিটজেরাল্ডের মোহ তারা পূর্ণরুপে কেটে উঠতে পারেন নি ৷ কান্তিচন্দ্র ঘোষের অনুবাদের বিশেষত্ব এইযে,ভাষার সরলতা,একটি বিশেষ ছন্দের বহুল ব্যবহার,শব্দচয়নে নৈপন্য,ভাবের একত্রিকরণ ৷ আর এসব কারনে কান্তিচন্দ্রের অনুবাদ সাধারনের কাছে গ্রহণযোগ্য ৷ বলা হয়ে থাকে "কান্তিচন্দ্র ঘোষ ফিটজেরাল্ডের 110 টি রুবাই-এর মধ্যে 76 টি রুবাই-এর হুবহু অনুবাদ করে গেছেন ৷"¹কিন্তু তার অনুবাদগুলোতে স্বাতন্ত্র্যতা লক্ষ্য করা যায় ৷যেমনঃ 

'Tis all a Chequer-board of Nights and Days
Where Destiny with Men for Pieces plays:
Hither and thither moves, and mates, and slays,
And one by one back in the Closet lays.

কান্তি ঘোষের অনুবাদঃ

ছকটি আঁকা সৃজন ঘরের
রাত্রী দিবা দুই রঙের,
নিয়ৎ দেবী খেলছে পাশা
মানুষ ঘুঁটি সব ঢঙের;
প'ড়ছে পাশা ধ'রছে পুনঃ,
কাটছে ঘুঁটি, উঠছে ফের—
বাক্সবন্দী সব পুনরায়,
সাঙ্গ হ'লে খেলার জের ৷

সিকান্দার আবু জাফরের অনুবাদঃ

দিন-রাত্রীর রঙ দিয়ে আঁকা দাবার ছকটি মেলে
নসীব খেলছে বিচিত্র খেলা মানুষের ঘুঁটি চেলে;
ঘর থেকে ঘরে চালে চালে ঘুঁটি পড়ছে মরছে আর
দান শেষ হলে আবার তাদের বাক্সে রাখছে ঢেলে ৷৷

যেখানে মূল ফার্সীঃ

মা ল'বতেগানীম ও ফলকে ল'বতেবায
আয রুয় হাকিকাতি নাহ্ আয রুয় মজায
এক চান্দ দর ইন বেসাত বাজী কারদিম
রফতিম বেহ সন্দুকে আদম এক এক বায ৷

(আমরা খেলনা আর আসমান খেলোয়ার—বাস্তবে দেখ কল্পনায় নয় ৷কিছুটা সময় এর মধ্যে দেওয়া-নেওয়ার খেলা করে—সিন্দুকে মানুষকে একে একে পুরে রাখে ৷) 

কাজী নজরুলের অনুবাদঃ

আমরা দাবার খেলার ঘুঁটি, নাইরে এতে সন্দ নাই!
আসমানী সেই রাজ-দাবাড়ে চালায় যেমন চলছি তাই ৷
এই জীবনের দাবার ছকে সামনে পিছে ছুটছি সব
খেলা শেষে তুলে মোদের রাখবে মৃত্যু-বাক্সে ভাই!

অনুবাদগুলো পর্যালোচনা করলে ফিটজেরাল্ডের অনুবাদের অতিরঞ্জিত কবি প্রতিভার লক্ষণ পাওয়া যায় ৷ আর বাংলা অনুবাদে তার আরেক রূপ পরিলক্ষিত হয় ৷ কান্তিচন্দ্র ঘোষ ফিটজেরাল্ডের সবটুকুই নিয়েছেন সিকান্দার আবু জাফরের মত তবু কবি কল্পনায় বিস্তর ফারাক ৷ কান্তিচন্দ্র ঘোষ ভাবকে সমান্তরালভাবে একীভূত করবার প্রয়াসে অত্যন্ত সচেতন ভাবে শব্দের ঘুঁটি চেলেছেন—আবদ্ধ করেছেন এক নিপুন ছন্দে যা খৈয়ামের কবিতার মূল ভাব সাধারনের বুঝতেও দেরী হয় না ৷ নরেন্দ্র দেবের অনুবাদে বিচিত্র ছন্দের প্রভাবে শ্রুতিজনিত সমস্যা কিছুটা উপলব্ধি হয় আর রুবাই এর অস্বাভাবিক আকার বৃদ্ধি অনেককেই তুষ্ট করতে পারে নি ৷ অন্যদিকে কাজী নজরুল ইসলামের রুবাইয়াত আরবী ঘোড়ার তেজে চলেছে নিখূঁত ছন্দে কেননা ফার্সী ভাষা আয়ত্তে থাকার ফলে মূলভাব তার আত্নগত ছিল ৷ তবুও তার অনুবাদ পূর্ণ আক্ষরিক না হয়ে বরং কবিকল্পনামিশ্রিত ভাবানুবাদ হয়েছে ৷ অনুবাদ যাই হোক না কেন মূলভাব সকলেই আত্মগত করার চেষ্ঠা করেছেন ৷ ভাব ঠিক করতে ছন্দ পরিবর্তন কিংবা ছন্দ ঠিক করতে ভাবের পরিবর্তন সর্বোপরি ৷ এক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলাম ব্যতিত ভাব, ভাষা কিংবা শব্দ ব্যবহার ও ছন্দের নৈপন্যে কান্তিচন্দ্র ঘোষ বিশেষত্বের দাবীদার ৷

রুবাইয়াতের পূর্ণ অর্থ অনেক অনুবাদে অনুপস্থিত ৷ ফিটজেরাল্ড কখনো রুবাই-এর দুই-এক চরণ নিয়েই একটি রুবাইয়াত করেছেন এবং অনেক সংস্করণে রুবাইয়াতগুলোকে পরিবর্তিত করেছেন ৷ বাংলায় অনুবাদকগণও তাদের অনুবাদে ব্যতিক্রম করেননি ৷ কেবল কাজী নজরুল ফিটজেরাল্ডকে অনুসরণ করেন নি তবুও তার অনুবাদে মূল ভাবার্থের সঙ্গে অসঙ্গতি,বিচ্যুতি ঘটেছে কবি-প্রতিভার দরুন ৷ সকলেই খৈয়ামের মর্মে প্রবেশ করতে চেয়েছেন ও বক্তব্যের রহস্যজালে বারংবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন ৷ কাজী নজরুল যেমন একাত্ম হতে চেয়েছেন তার মূল স্পর্শ করে তেমনি কান্তি ঘোষ একাত্ম হতে চেয়েছেন তার ভাবের মধ্যে ৷ তাই অনুবাদগুলো দুই মেরুতে অবস্থান করছে ভিন্নরুপে ৷ এটি মূলের সাথে সম্পর্কভিন্ন পূর্ণ আক্ষরিক না হয়ে অনুবাদকের মৌলিক রচনায় স্নানান্তরিত হয়েছে ৷  যেমনঃ
   
“How sweet is mortal Sovranty!”—think some: 
Others—”How blest the Paradise to come!”    Ah, take the Cash in hand and waive the Rest; 
Oh, the brave Music of a distant Drum!

কান্তি ঘোষের অনুবাদঃ

রাজ্যসুখের আশায় বৃথা
কেওবা কাটায় বরষা মাস;
স্বর্গসুখের কল্পনাতে
পড়ছে কারুর দীর্ঘশ্বাস ৷
নগদ যা’পাও হাত পেতে নাও,
বাকীর খাতায় শূন্য থাক্ ―
দূরের বাদ্য লাভ কি শুনে? ―
মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক ৷ 

যেখানে নজরুলের অনুবাদঃ

করছে ওরা প্রচার―পাবি স্বর্গে গিয়ে হুর পরী,
অামার স্বর্গ এই মদিরা,হাতের  কাছের সুন্দরী৷
নগদা যা পা’স তাই ধরে থাক,ধারের পণ্য করিসনে,
দূরের বাদ্য মধুর শোনায় শুন্য হাওয়ায় সঞ্চরী ৷

মূল ফার্সীঃ

গবিন্দ কসান ভেস্ত্ বা হুর খোশ আস্ত
মান মেগবিম কেহ আবে আঙ্গুর খোশ আস্ত
ইন নক্বদে বগীর ও দস্তে আয আন নসিয়েহ বেদার
কাওয়াজ দহলে শানিদনে আয দুর খোশ আস্ত ৷

(সকলে বলে বেহেস্তের আনন্দ হুরপরীতে―আমি বলি আমার আনন্দ দ্রাক্ষারসে ৷ বাকী মুল্যের জন্য নগদ হাতছাড়া কর না―দূরের খুশির বাদ্য তীব্রই শোনায়)   
 
অনুবাদগুলো বিচার করলে নজরুল ও কান্তি ঘোষের অগাধ প্রতিভা ও  কবিত্বশক্তির পরিচয় পাওয়া যায় ৷ যেখানে ভাষা মূখ্য নয় ভাব মূখ্য ৷ মূল থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হলেও কান্তি ঘোষ তার অনুভূতি থেকে বিচ্যুত হননি ৷ এখানে যেন খৈয়ামের বাক্য প্রধান নয়, প্রধান তার অন্তর্নিহিত দর্শন ৷ এই দ্বন্দ্ব থেকে ফিটজেরাল্ডও মুক্তি পান নি ৷ দ্রাক্ষারসে খৈয়াম জারিত হয়েছেন তিলে তিলে আর বর্তমানকে আঁকড়ে ধরে দূরের স্বর্গমোহ ত্যাগ করেছেন তেমনি খৈয়ামকে আঁকড়ে ধরে কবিগনও যেন তার ভাবসমুদ্রে অন্তঃর্লীন হয়েছেন ৷  

কান্তি ঘোষের অনুবাদে ফার্সী শব্দের যথাসামান্য ব্যবহার আছে যেমন প্রয়োজনের তাগিদে তেমনি নিয়ৎ দেবী,দেব,দেবতা,যুক্তিদেবী,ভাগ্যদেবী,ভাগ্যসুতো,পুজো,মাঙ্গলিক,দৈববাণী,নমস্কার,আশীষ,পঞ্চভূত,বিশ্বরথ,বিধানরথ,স্বর্গদূতী,মন্দির,উপোস,দ্রাক্ষাদেবী,দ্রাক্ষাবঁধু,তৃণাসন,চরকাসুতো,দিব্যি ইত্যাদি শব্দগুলি অধিকতর পরিভাষিক শব্দ হিসেবে বেছে নিয়েছেন ৷ অন্যদিকে কাজী নজরুলের অনুবাদে যথাযথ ফার্সী শব্দের বহুল ব্যবহার অাছে  পরিভাষিক শব্দের তুলনায় ৷ ভাগ্যলক্ষ্মী,স্বর্গদূত, দেবী-প্রতিমা,প্রভু ইত্যাদি কতিপয় পারিভাষিক শব্দ ব্যতিত ফার্সী মুসলমানি শব্দের অবাধ ছড়াছড়ি তার অনুবাদে ৷ কাজী নজরুল ইসলাম তার অনুবাদে কককক/ককখক মূল ছন্দরীতি অনুসরণ করেছেন আর কান্তি ঘোষ মূল ছন্দ ব্যতিরেকে স্বরবৃত্ত ছন্দ ককখখ অন্ত্যমিলে রুবাইয়াতগুলোকে কাঠামোতে আবদ্ধ করেছেন ৷ যেমনঃ

কান্তি ঘোষঃ

সেই নিরালায় পাতায় ঘেরা
     বনের ধারে শীতল ছায়,
খাদ্য কিছু,পেয়ালা হাতে
      ছন্দ গেঁথে দিনটা যায়!
মৌন ভাঙ্গি মোর পাশেতে
            গুঞ্জে তব মঞ্জু সুর ―
সেই তো সখি স্বপ্ন আমার,
               সেই বনানী স্বর্গপুর!

কাজী নজরুল ইসলামঃ

এক সুরাহী সুরা দিও,একটু রুটি ছিলকে আর
প্রিয় সাকী,তাহার সাথে একখানা বই কবিতার,
জীর্ণ আমার জীবন জুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সাথ,
এই যদি পাই চাইব না কো তখৎ আমি শাহানশার!

খৈয়ামের ফার্সী রুবাইয়াতের অনুবাদগুলো বাংলায় অবিকল বিষয়বস্তুতে  আসেনি ৷ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বক্তব্য হল ফার্সী থেকে অনুবাদ আর ইংরেজী থেকে অনুবাদ;এই দুই শ্রেণি সম্পর্ণ আলাদা ৷ তাই কাজী নজরুলের সাথে কান্তি ঘোষের অনুবাদ যেমন স্বতন্ত্র তেমনি ফিটজেরাল্ডের অনুবাদ আর কান্তি ঘোষের মধ্যে অমিল এবং কাজী নজরুল আর ফার্সী রুবাইয়াতের মধ্যে অমিল দৃষ্টিসাপেক্ষ ৷ 
কান্তি ঘোষের অনুবাদ মূলের সাথে আংশিক সঙ্গতিপূর্ণ তাই তা মৌলিক রচনারই নামান্তর ৷ কেননা তিনি ফিটজেরাল্ডকেও পূর্ণভাবে অনুকরণ করেন নি ৷ কাজী নজরুল ও কান্তি ঘোষের মধ্যে উপরোল্লিখিত মিল বিদ্যমান থাকলেও কান্তি ঘোষের মূলের সাথে ভাবের বিচরণ বিচ্ছিন্ন এবং তাতে খৈয়ামের দর্শন ও রসপ্রাপ্তি ঘটে কিন্তু পাঠকের মনে সংশয়ের উদ্রেক করে ৷ কান্তি ঘোষের অনুবাদ ‘এর জিনিসটা বস্তু নয়,গতি’―রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উক্তিটিই বিশ্লেষণসাপেক্ষ ৷ মৌলিক রচনা হিসেবে কান্তি ঘোষের অনুবাদ বিশেষ কৃতিত্বের দাবীদার এবং খৈয়াম দর্শন বিশেষভাবে উপলব্ধির কারণে তার অনুবাদ মূল ব্যতিরেকেই বাংলায় রুবাইয়াত ই ওমর খৈয়াম হিসেবেই পরিগনিত হবে লোকদৃষ্টির অন্তরালে ৷

মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

আগন্তুক

★আগন্তুক
    রায়ান নূর

ঘরের দরজায় কড়া নড়ছে অবিরত ৷ এ অসময়ে ভরদুপুরে কে এল আবার? সকাল থেকে হাড়ভাঙা খাটুনির পর এতটুকু বিশ্রাম নেই ৷  কে জানে নতুন কোন খদ্দের-টদ্দের হবে ৷ যে দিনকাল পড়েছে তাতে একটু শান্তিতে থাকার জো নেই ৷
‘ আরে ঐ বকুল, দেখতো কে এল আবার এই ভরদুপুরে? ’ 
দুপুরের কড়া রোদের তাপে বাড়ির ছাউনির টিনগুলো ঝকঝক করছে ৷ দূর থেকে দেখলে ভদ্রলোকের কোন বাড়িই মনে হবে ৷ বাড়ির পাশে একটি পচা নর্দমা,কতদিন হল নানা অরুচিকর আবর্জনায় ভরপুর ৷
      তিনটি মাত্র ঘর ৷ পাশের ঘর থেকে গানের গলা শুনা যায় গুনগুন করে ৷
‘ যাই, বুড়ী মাগী, দুপুর বেলায়ও জ্বালিয়ে খাবে দেখছি ’
‘বাবু-টাবু হলে ফেরাবি না,যে দিনকাল পড়েছে ! সতীপনা অনেক হল ৷’
‘ যাই, কী জ্বালাতন ! বাঁচতে দিবেনা দেখছি ৷’

বুড়ী আবার ঝিমিয়ে পড়ল ৷ দরজা খুলতেই টিনের আলোর ঝলকানি পেয়ে বকুল কিছুটা অপ্রকৃতস্থ হয়ে যায় ৷
    সেদিনের কথা ৷ বকুলের যৌবন এসেছে পদ্মপাতার একফোঁটা বৃষ্টির মত ৷ হারিয়ে গেছে চৈতন্য ৷ কেবল একটা ভাবনায় মন চড়ই পাখির মত একতলা থেকে লাফিয়ে বহুতলায় উঠে ৷ সে নিজেই জানে না কি ভাবে সে? হাত-পা গুলো সুস্থ্যসবল খরগোশের মত লাফিয়ে বেড়ায় দীঘিতলা থেকে বাঁশঝাড় পর্যন্ত ৷ মনটা ছুটে বেড়ায় রাজকুমারের কোন গোপন অভিসারে এতটুকু আশ্রয়ের আশায় ৷ মন যত কল্পনায় ডানা মেলে বন্দীত্বের বেড়া ততই নিকটে আসে ৷
    অরণ্য সেদিন এমন করেই তার কাছে এসেছিল ৷ এতটুকু ভুল হয় নি বকুলের ৷ তারপর কত হাসি,কত কথা ৷ প্রাণটা তখন চড়ুইয়ের গড়া বাসায় প্রবেশ করে নি ৷ সামান্য রঙমিস্ত্রির কারুকাজে যাদু থাকে? অবিশ্বাস্য,হতেই পারে না ৷ কিন্তু তাই হয়েছিল ৷ বকুলের মত মেয়েকে কাছে পাবে তা কোনকালে ভাবতে পারে না অরণ্য ৷
    তিনমাস হয়েছে তাদের ঘরসংসার করা ৷ ঈদ উপলক্ষে বকুল নিজ বাড়িতে এল ৷ লুকিয়ে রাখল সইদের কাছে না বলা কথাগুলো ৷

জয়হাটে এই বুড়ী মাগী কেমন? বকুল বুঝতে পারে ৷ তাছাড়া শিপুবাবু কেন এত ছলচাতুরি করে এই বাসায় থাকল কেবল বুড়ীই জানে ৷ কদিন বাদে চলে যাবে আকাশের তারা গোনা শিখিয়ে, আর দোয়াতের কালি ফেলে সাদা কাগজ নষ্ট করবে, অথচ মনমতো কিছুই আঁকবেনা বকুল কখনো কল্পনা করে নি ৷
        বকুলের আজও মনে পড়ে সেই রাত্রের কথা ৷ শতচেষ্টায় ভুলতে পারে না ৷
    কি ঝড়? গাছের ডালগুলোর এমন শব্দ আর অস্থির নড়াচড়া,শেষপর্যন্ত একতলার টিনের ছাউনির মিনারের উপর আছড়ে পড়তে শুরু করল ৷ বকুল ভয়ে অস্থির ৷ বাতাসের সে কি গর্জন যেন কানে তালা লেগে যাবে ৷ গায়ের চামড়াগুলো মনে হয় ছিড়ে ফেলবে ৷
     ঝড় শেষ হয় ৷ রাতে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে ৷ ভ্রমর জেগে উঠে মধুরসে ৷ পাশে পিঁপড়েগুলোর আনাগোনা চলছিল শেষরাতে পর্যন্ত ৷ রাত বিদীর্ণ করে লাল সূর্য ক্রমশ সাদা হয়ে তার রুপালী আলো বকুলের ঘরের জানালায় ফেলল ৷ জানালার রড বেয়ে বেয়ে দুটো শিশিরের দানা নিচে মাটির ঢিবির মাঝে পিঁপড়ের একটি ছোট গর্তে তখনো পড়ছিল ৷

বকুল শহর থেকে বাড়ী  ফিরেছিল ৷ তার বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে আসে আপদ দূর করার জন্য ৷ সমাজে এমন কলঙ্ক যেন ছড়িয়ে না যায় ৷ যদিও বোন তবু তাড়া পরিবারশুদ্ধ দরজায় খিল এটে বসে থাকে ৷ কত অনুনয় করল তবু তাদের পাষাণ হৃদয় একটু গললো না ৷ ভাইয়েরা আজ বউদের সাথে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গলা মিলিয়েছে ৷
    শহরে ঝিয়ের কাজ করে বোন এটা কি গৌরবের কথা? একবেলা খাবারও জোটেনা তার বাড়িতে ৷ যেদিন দরজার চৌকাঠ পেরিয়েছে সেদিনই তার মরণ ৷ এখন যে এসেছে তাকে কি কেউ ভালো চোখে দেখবে ৷
      ভাইদের কত পায়ে পড়ল মাথা গোঁজার এতটুকু ঠাইয়ের জন্য ৷ কিন্তু কেউ তাকে বিশ্বাস করলনা ৷ প্রতিবেশীরা কানাকানি শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে ৷ পাশের বাড়ির একবুড়ী তো গলা ছেড়ে দিয়ে সব কীর্তন শুরু করেছে ৷
    ‘ এই মাগীকে বাড়ী তুললে জাতধর্ম সব যাবে ৷ মুসলমান কুলের এত কলঙ্ক,হাদীস-কোরান কি মায়ে শিখায় নি ৷ তবুও শহরে পয়সাওয়ালা বাবুদের উপর নজর পড়েছে ৷ ও কিছুতেই সিঁধে হবে না বলে রাখছি ৷ বয়স আমার কম হলোনা, অনেক দেখেছি ৷’
    ‘চুপ কর বুড়ী, তোর কাজ কর গিয়ে ৷ পেঁচাল পারার জায়গা পাস না ৷’
     ছোটভাই বুড়ীকে থামিয়ে দিল এক গলায় ৷ বুড়ী তবু থামেনা, পাড়াময় কানাকানি শুরু করে দিল ৷
‘ কি রে,খাওয়া-দাওয়া করেছিস ৷ তুই আয় ভিতরে ৷’
ছোট ভাইয়ের আস্পর্ধা দেখে বউয়েরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল ৷ ছোটভাই যখন নরম হয়েছে তখন বড় ভাই কিছুটা সায় দিল, কড়া কথা কিছু বলল না ৷
‘কাজটা কিন্তু ভালো করলে না ৷ তাড়াতাড়ি বিদায় কর ৷ অশান্তি আর সহ্য হয় না ৷’

বড় ভাইয়ের কথা আর বউদের গলা উপেক্ষা করে ছোট বলল,‘তোমাদের এত আপত্তি কোথায়?’বকুল কি চোর,ডাকাত না জন্তু ৷’
মেজো ততক্ষণে এসেছে ৷ এসেই তো রাগবাগ শুরু ৷ ছোট ঝাঙলার বাঁশ ভেঙে বকুলের দিকে তেড়ে আসল ৷ বড় ভাই আঁটকাতে গিয়ে ফাটা বাঁশের মাথা লেগে হাত কেটে ঝরঝর করে রক্ত বের হতে লাগল ৷
      এত সাহস দেখে বড় বউ মেজো বউয়ের চুলের ঝুটি ধরে রণক্ষেত্রে পরিণত করেছে ততক্ষণে ৷ ছোটবউ বড়ো বউয়ের পক্ষ নিয়েছে ৷ সে কম যায়  কিসে?
     মেজো ভাই আর স্থির থাকতে পারল না ৷ বাঁশটির এক ঘা বসে দিল ছোট বউয়ের মাথায় ৷ মাথা ফেটে রক্ত বের হতে লাগল ৷ তবু থামল না ৷ ছোট ভাই কোন দিকে সামলাবে ৷ ভাইকে সামলাবে না বউকে ৷
       ক্রমেই মারামারি শুরু হয়ে গেল ৷ পাশের বাড়ির তমিজ বুড়া মারামারি থামাতে গিয়ে সেও কিল থাপ্পর খেল কয়েকটা, আর যায় কোথা!
       গোটা পাড়া শুরু হয়ে গেল মারামারি ৷ প্রত্যেক বাড়ির কেউ না কেউ মার খেয়েছে একটু-আধটু ৷ তাই সবাই দুইপক্ষ হয়ে গেছে ৷
     সন্ধ্যা নেমে আসল ৷ বকুল ভয়ে ঘরে জড়সড় হয়ে বসে আছে ৷
কে যেন এসে বকুলকে দরজা খুলে চড়লাথি মারতে লাগল, বেশি ভিড়ের মধ্যে দেখা গেল না ৷ ভাইয়েরা জানতে পেরে তিনজনে ছুটে আসল ৷
   বকুলের জ্ঞান ফিরল অবশেষে ৷ বড় ভাই লুকিয়ে কারও মাধ্যমে বকুলকে ঘর থেকে বের করে গ্রামের বাইরে দিয়ে আসল ৷

    রাতদুপুর হয়, ঝগড়া শেষ হয় না ৷ বুড়ীটাও কয়েক ঘা খেয়েছে তাই তার জ্বলন উঠছে ৷ এই বাড়ীর তিনভাই-তিনবউ একপক্ষ আর পাড়ায় দুইপক্ষ এই তিনপক্ষের ত্রিপক্ষীয় মারামারি শেষে এখন ঝগড়া চলছে ৷
    সকাল হলে আর এক কারণ নিয়ে আর একদফা হল ৷ এতে গোটাকয়েক হাসপাতালে ভর্তি হল ৷
   গাঁয়ে বিচার সালিসে মাতব্বর কাওকে কাওকে দুই এক থাপ্পর দিয়ে কোলাকুলি করে দিল ৷ আর বকলে খানিকটা নিজের খেয়ে পরের মোষ তাড়ার জন্য ৷
   এই বিচার একপক্ষ মানলো না ৷ মেরে পার পেয়ে যাবে এতই সস্তা  ৷ থানায় মামলা করবে তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিল ৷ ওরাও যে মেরেছে সেই কথা আরেক পক্ষ যখন শুনিয়ে দিল তখন সবাই ঠান্ডা হল ৷

বকুলের সেই দিনের স্মৃতি ভুলতে পারে না ৷ শিপুবাবু তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে নর্দমায় ফেলে দিয়েছে বকুল তা বেশ বুঝতে পারে ৷ বুড়ী বড় বড় বাবুদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ইজ্জ্বত নিয়ে এভাবে খেলবে আর সেই টাকায় সেই বস্তির কয়েক  লম্পট লোক ভাগ বসাবে এমন কথা ভাবতেই তার অন্তরটা পুড়ে খাক হয়ে যায় ৷  
     ঝিয়ের কাজ করত বকুল ৷ শিপুবাবু প্রায়ই আসত এই বাড়িতে ৷
নতুন জীবনের স্বপ্নে সে অনেক কিছু হারানোর পরও প্রশান্তি পেত ৷ বিয়ে করবে এমন আশ্বাসও দিয়েছিল ৷ কিন্তু নিয়তি তার সাথে খেলা করল ৷
     শিপুবাবু এক কসমেটিক কোম্পানির রিপ্রেসেন্টিভ ছিল ৷ কয়েকমাসের জন্য বদলী হয়ে এসেছিল, একথা বুড়ী জানত ৷ টাকার লোভে বুড়ীর বিবেকবুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে ৷ যে প্রথম তাকে নিজের মেয়ের মত চুলের খোঁপা বেঁধে দিত, রান্না করে খাওয়াতো ৷ সে কিনা নিজের হতবুদ্ধিতে পাড়ায় দুষ্ট লোকের গোলাম ৷

‘ বকুল,কেমন আছ তুমি, ব্যবসা ভালোই চলছে তো ৷ রেট কেমন এখন?’

বকুলের গায়ে মুহূর্তের মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে ৷ চোখ দুটো দিয়ে বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গের মত জ্যোতি বের হয়, তবু তাকে শান্তভাবে বলে ৷
‘ তা তুমি শুনে কী করবে? আমাকে কি পতিতা ভাবো তুমি ৷’
‘ না,না ৷ তা হবে কেন? ঐ বুড়ী কি মিছেমিছি আমার কাছ থেকে টাকা নেবে ৷  তুমিও তো কম যাও না ৷’
‘ তাহলে তুমিও, তোমার ঘরে কি বউ নেই?’
‘ থাকলে কি আসি রসরাজ্যে ৷’
‘ তবে যে বিয়ে করবে বলেছিলে ৷ ’
‘ তোমাকে! হতেই পারে না ৷’

শিপুবাবু হাসতে থাকে আর বকুলের রাগের মাত্রা বাড়তে থাকে ৷ তপ্ত বালুতে ধান পড়লে যেমন খই বের হয় বকুলের অবস্থা তাই হল ৷
‘ লম্পট,বদমাশ,তবে মিছে মিছি ভালোবাসা ৷’
‘হুম ৷ জানো, বস্তির লোকেরা তোমার বাড়িতে ঢোকার সময় যখন আমার সকল টাকা কেড়ে নিয়েছিল তোমার নাম করে ৷ সেদিন ভুলেই এই বাড়িতে পা দিয়েছিলাম ৷ তখন তো জানতাম না এখানে এই কাজ হয় ৷ আর তুমি নিজেই.... ’
‘ কত টাকা নিয়েছিল? হাজার টাকা? কত....’
‘ রাখো ওসব, ঠাণ্ডা জল দাও ৷ এ লাইনে যখন লোকসান হয়েছে তো লাভের অঙ্কটা কম কিসে? সব শিখে ফেলেছি ?’

বকুলের আর চৈতন্য থাকে না ৷ সে নেশাগ্রস্ত উন্মাদ হয়ে যায় ৷ সবাই লাভ খোঁজে, সে কেন ক্ষতির মুখে পড়বে ৷
     পাশের বস্তির শুভ্রও আসত মাতাল হয়ে এ বাড়িতে ৷ সে প্রায়ই এখানে থাকত পাশের ঘরে ৷ বকুলকে কিছু বলার সাহস পেত না ৷ তার চোখ দুটো কেমন ক্ষুধাতুরের মত লাগত ৷ তার চোখের ভাষা বকুল বুঝে উঠতে পারতনা ৷ বকুল কোন রাগারাগি করত না,কারণ তার উপরও বকুলের দূর্বলতা তৈরি হয়ে ছিল ৷ সে মাঝে মাঝে বলত, ‘ বকুল চল, দুজনে কোথাও চলে যাই, আর এখানে ভালো লাগে না ৷ ’

যার আশায় থেকে বকুল মালা গেঁথেছিল সে শিপুবাবু তার এই পথে নামার প্রথম খদ্দের তখন, ভরসা কার উপর ? রাগ হলেও বকুল অনেক কিছু করতে পারে কিন্তু সেই পাশবিক জন্তুতা বকুলের সব সময় জাগে না ৷ জাগলে তার সকল স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে যায় তখন প্রেম-ভালবাসাকে কামনার খোরাক বলতে মুখ তার এতুটুকু আঁটকে না, যে কাছে আসে তাকে আরো কাছে টানে ৷ কী দূর্বিসহ সে জীবন অভিজ্ঞতা! পশুর মত ছিড়ে খায় একে অপরকে ৷ কিন্তু শুভ্রকে দেখে শান্ত মনে হয় ৷ একটা বিড়াল ইঁদুর দেখলে শিকারের জন্য উন্মত্ত থেকে শান্ত ভাবে থাকে তার চোখ যেন সে কথাই বলে ৷
     শুভ্রকে এতটুকু ভয় হয় না বকুলের, যত ভয় কিরণবাবুর কাছে ৷
হঠাৎ হঠাৎ আসে আর ছিড়ে খায় মাঁকরসার জালে আঁটকানো মশার মত ৷ এই তো কয়েকদিন আগেই এসেছিল ৷ কী অসহ্য সে রাত, কী পূর্ণ সেই প্রাপ্তি যেন তৃষ্ণার্ত বুকে একফোঁটা মধুর ছিটা ৷ মনে হলে সারা শরীর শিহরে উঠে,কাঁপতে থাকে জলভরা চঞ্চু ৷ ব্যকুল হয়ে উঠে শরীর-মন ৷ ভুলে যায় পৃথিবীর সকল নিয়ম কানুন আর মায়ার বাঁধন ৷ বিশ্বাস তাকে পীড়িত করে না ৷ খোদাকে নির্বিকার আখ্যা দিয়ে পাষাণের প্রত্যেক প্রস্থ গরম পানি দিয়ে ধৌত করে ৷ স্বয়ং দ্রষ্টা স্বেচ্ছায় অন্ধত্ব বরণ করেছে নইলে এই দৃশ্য তার সইবে কেন?
‘ব্রাণ্ডি আছেরে বকুল,গা টা গরম করি ৷’
‘আমরা কি ওসবের ব্যবসা করি, তাই থাকবে?’
‘বুড়ীকে বল দেখি,ওনি তো বস্তি পাহাড়া দেন ৷’

পকেট থেকে টাকা বের করতেই পাঁচশ টাকার কতগুলো নোট বের হয়ে এল ৷ তা থেকে বকুলকে তিনটা নোট দিল ছোট ব্রাণ্ডি নেবার জন্য ৷
   বুড়ী বাইরে মতিকে দিয়ে দুনম্বরি একটা ও একটা অরজিনাল ব্রাণ্ডি এনে নিল ৷ যদি বাবু বুঝতে না পারে নকলটা চালাবে তাতে মতি আর বুড়ীর ভাগ ষোলোআনা কিন্তু বকুল তাতে শূন্য ৷ বকুল এই রাস্তার মানুষগুলির খোরাক তাই বিনিদ্র প্রহরা ৷ মানবদেবতাদের তুষ্ট করে তার ভাগ শূন্য থাকে বরাবরই ৷
   কিরণবাবু নিয়মমত ট্যাক্স নেন তিনি যে দারোগা ৷ তাছাড়া ভদ্রবাড়ীর কীর্তি ফাঁস হয়ে গেলে দাম কমে যাবে ৷ রাস্তার ভিখারীও আসন পেতে বসবে ৷ এমন সুন্দরীর মেয়ের অকল্যান কেউ চায় না তাই রাণীর আসনে বসায়ে তারা দরকষাকষি করে ৷ 
    
রাত লাগলেই শুভ্র আজ উন্মাদের মত ছুটে এল ৷ তার মুখে যেন সব কথা ফুরিয়ে গেছে ৷
‘কী হয়েছে রে শুভ্র ৷ তুই এত ঘেমে গেছিস ক্যান?’
‘আর বলিস না, নিজ চোখে দেখেছি ৷ কিরণবাবু !’
‘কিরণবাবু ! কী হয়েছে ?’

‘কে এল বকুল?’―পাশের ঘর থেকে শিপুবাবুর গলা শুনা যায় ৷
‘কে বকুল ও ঘরে ৷’
‘শিপু, আস্তে কথা বল ৷’
‘তুমি আবার! সে দিন না কসম খেলে ৷’
‘চুপ কর ৷ ’

শুভ্র রাগে গরগর করে ৷ তার শিরাগুলো কাঁপতে থাকে ৷ বকুল ও ঘরে যায় ৷ আসল ব্রাণ্ডি খেয়েই সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় যবনিকামোচন করে শিপু ৷ এলায়িতভাবে বকুল শুভ্রর কাছে আসে, মুখে কোন কথা নেই ৷ শুভ্রর দুচোখ জড়িয়ে আসছে ৷
‘ তুমি আবার কসম ভাঙলে ৷’
বকুল কোন কথা বলে না ৷ কেবল ঠায় মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে ৷
‘বকুল কিরণবাবু যে মেয়েটির কথা বলেছিল সেদিন ৷ সে আত্মহত্যা করেছে ৷ ’

বকুল শুভ্রকে হাঁফ গ্লাস ব্রাণ্ডি খাইয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,‘যাবে?’
‘কোথায়,কখন ৷’
‘সকালে,বিয়ে করব ৷’
‘বিশ্বাস হয় না,পতিতার সংসার ! মর ’
বকুল কথার ঘা সহ্য করতে না পেরে হাঁফ গ্লাস ব্রাণ্ডি খেল ৷ বুকটা কেমন ক্ষণিকের তরে তেতে উঠল ৷
   শুভ্রর চোখ মুঁদিয়ে আসলো,তাকাতে পারল না আর ৷ ডাকলো কয়েকবার―কোন সাড়া নেই ৷ বকুল ফিরে গিয়ে ব্রাণ্ডির বোতলটায় দেখে তার মুখে কোন সিল নেই ৷ তৎক্ষণাৎ বকুলের রঙিন জগতটাও কেমন মিলিয়ে গেল আকাশে তারার মত ৷ কেবল ঘোর অন্ধকার, বেচেরাগ!